ভারতের বিশ্ব রাজনীতি ও মার্কিন হুমকি

চাবাহারে ভারত-ইরান ১০ বছরের চুক্তির ফলে ভারত, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ‘সম্ভাব্য ঝুঁকির’ সম্মুখীন। তবে ইরান বন্দর চুক্তি নিয়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকি খারিজ করে দিয়েছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, তাদের কোম্পানি ইরানে একটি কৌশলগত বন্দর প্রকল্পের সুবিধাগুলো যোগাযোগের বৃদ্ধির জন্য কাজ করবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, প্রকল্পে কাজ করা ভারতীয় সংস্থাগুলো নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে রয়েছে। ইরান এবং ভারত এ সপ্তাহে চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা নয়াদিল্লিকে ১০ বছরের সুবিধা প্রদান করবে। এর ফলে বর্তমান সরকারের পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা সফল হবে। এ সপ্তাহে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড (আইপিজিএল) আগামী দশকে ‘কৌশলগত সরঞ্জাম সরবরাহ’ এবং ‘বন্দরের পরিবহন পরিকাঠামো উন্নয়নে’ ৩৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। ভারতের সঙ্গে বর্তমানে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ। যা ইরানের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক এবং ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হামাসের প্রতি তেহরানের সমর্থনের কারণে এ সম্পর্ক আরো খারাপ হয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানে থাকাকালীন যুক্তরাষ্ট্র এ ইরানের বন্দর প্রকল্পটির বিষয়ে কিছু বলেনি। কারণ ২০২১ সালে পতন হওয়া কাবুল সরকারকে সমর্থন করার জন্য নয়াদিল্লিকে ওয়াশিংটন অংশীদার হিসেবে দেখেছিল।

প্রশ্ন হলো ইরানের চাবাহার বন্দর চুক্তিতে ভারত কি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি নেবে? ভারত ইরানের কৌশলগত চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য একটি ১০ বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কারণ নয়াদিল্লি তার পশ্চিম প্রতিবেশী এবং চির শত্রু পাকিস্তানের বন্দরগুলোকে বাইপাস করে স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে চায়। ইন্ডিয়া পোর্ট গ্লোবাল লিমিটেড (আইপিজিএল) এবং ইরানের পোর্টস অ্যান্ড মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (পিএমও) দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। দক্ষিণ-পূর্ব সিস্তান-বেলুচেস্তান প্রদেশে এবং ওমান উপসাগরে অবস্থিত চাবাহার বন্দর দু’টি পৃথক বন্দর নিয়ে গঠিত- শহীদ কালান্তারি এবং শহীদ বেহেশতি। ভারত শহীদ বেহেশতীতে একটি টার্মিনাল পরিচালনা করবে। চুক্তি অনুসারে এটিকে উন্নয়ন করার জন্য ১২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। বন্দরে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ২৫০ মিলিয়ন ডলার লোন ক্রেডিট সুবিধা চুক্তিসহ মোট মূল্য ৩৭০ মিলিয়ন ডলার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২০১৬ সালের ইরান সফরের সময় বন্দরটির উন্নয়নের জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। তখন, নয়াদিল্লি গভীর সমুদ্র বন্দরটিকে একটি ট্রানজিট হাব হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে একটি ৬০০ মিটার দীর্ঘ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সুবিধা পুনর্গঠনের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। চাবাহার পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর থেকে প্রায় ১৪০ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর অংশ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ডিসেম্বর ২০১৭ সালে, আফগানিস্তানে ভারতীয় গমের প্রথম চালান চাবাহার হয়ে যায়— যা ছিল পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে যাওয়া স্থলপথের বিকল্প। চাবাহার চুক্তি পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের লেনদেনের বিরুদ্ধেও একটি বাধা।

যে কোন সময় পদত্যাগ করতে পারে নির্বাচন কমিশন
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় সংস্থাগুলোকে রাশিয়ায় প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি রপ্তানির বিষয়ে সতর্ক করেছে। মার্কিন সরকারি কর্মকর্তারা ভারতীয় কোম্পানি এবং রপ্তানিকারকদের সতর্ক করেছে। যাতে তারা রাশিয়াকে বিভিন্ন উপকরণ এবং প্রযুক্তি সরবরাহ করা থেকে বিরত রাখে। যা রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জামগুলোতে ব্যবহার করা হতে পারে। যদি ভারতীয় কোম্পানিগুলো তা না মানেন, তাহলে তারা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে। উপকরণ এবং প্রযুক্তিগুলো হলো ইলেকট্রনিক উপাদান, মেশিন টুলস, ড্রোন এবং ড্রোনের জন্য সফটওয়্যার যা দ্বৈত ব্যবহারের আইটেম, রাসায়নিক, বৈমানিক যন্ত্রাংশ এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় ব্যবহার করা যেতে পারে এমন উপাদান। যা বেসামরিক এবং সামরিক উভয় অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে পশ্চিমাদের দ্বারা আরোপিত নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এদিকে জাপান বেঙ্গালুরুভিত্তিক এসআইটু মাইক্রো সিস্টেমের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা করেছে, যারা ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম ডিজাইন এবং তৈরি করে। একই কোম্পানিকে রাশিয়ার সামরিক ও প্রতিরক্ষা শিল্প ঘাঁটি সহযোগিতা করার অভিযোগে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং গত নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। মজার বিষয় হলো, এসআইটু মাইক্রো সিস্টেমের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মাত্র এক মাস আগে, আইআইটি মাদ্রাজের সিলিকন ফোটোনিক্স রিসার্চ সেন্টার অব এক্সিলেন্সের উদ্বোধনের সময়, এটিকে ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক শিল্পের অন্যতম অংশীদার হিসেবে নামকরণ করা হয়েছিল।

জুলাই ২০২৪ সালে ২২তম ভারত-রাশিয়া বার্ষিক সম্মেলনের সময় রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গভীর সম্পর্ক মার্কিন প্রশাসন এবং অন্যান্য অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্র পছন্দ করেনি। কারণ ভারত, ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে ‘যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু এবং কোয়াডের সদস্য’, তাই তারা ভারত পশ্চিমা বিশ্বের মতামত অনুসরণ করবেন বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু ভারত তার পররাষ্ট্র নীতিতে ‘পছন্দের স্বাধীনতা’ এবং ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ নীতি অনুসরণ করছে। নয়াদিল্লি মস্কোর সঙ্গে তার সম্পর্ককে বিঘ্নিত না করে যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের একটি প্রধান কারণ হলো তেল। ২০২৩ সালে ভারত-রাশিয়ার বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা দুই দেশ ২০২৩ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে সম্মত হয়েছে। ভারত রাশিয়ার তেলের বৃহত্তম ক্লায়েন্ট এবং চীনের ঠিক পরেই এর দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক। কারণ ভারত ছাড়কৃত মূল্য দিয়ে রাশিয়া থেকে তেল ক্রয় করে।

২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে, রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল ভারতের মোট তেল আমদানির প্রায় ৩৬ শতাংশ, যা প্রায় ২৩২.৩১ মিলিয়ন টন বা ১.৭০ বিলিয়ন ব্যারেল। অনুমান করা হয় যে, এপ্রিল ২০২২ এবং মে ২০২৪ এর মধ্যে ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলো ছাড়ের হারে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কিনে, ১০.৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সাশ্রয় করেছে। রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা ভারতকে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ান দেশগুলো থেকে আমদানি কমাতে সক্ষম করেছে। এ ছাড়াও, ভারতের প্রচলিত সামরিক হার্ডওয়্যারের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সোভিয়েত বা পোস্ট-রাশিয়ান বংশোদ্ভূত। গত দুই দশকে, রাশিয়া ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের ভারতের অস্ত্র কেনার প্রায় ৬৫ শতাংশ সরবরাহ করেছে। জুলাইয়ের শীর্ষ সম্মেলনের সময়, দুই পক্ষই ‘মেক-ইন-ইন্ডিয়া প্রোগ্রামের অধীনে রাশিয়ান অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খুচরা যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য পণ্যের ভারতে যৌথ উৎপাদন করতে’ সম্মত হয়েছিল। দিল্লি ও মস্কো অতীত এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্ভরযোগ্য বন্ধু। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর বলেন যে ‘রাশিয়া কখনোই ভারতের স্বার্থে আঘাত করেনি, মস্কো-নয়াদিল্লি সম্পর্ক সব সময় স্থিতিশীল।’ রাশিয়ার বিষয়ে ভারতের অবস্থান, “স্বার্থ থেকে উদ্ভূত, স্বায়ত্তশাসিত বিদেশ নীতির নীতি এবং বন্ধু নির্বাচনের স্বাধীনতা” দ্বারা পরিচালিত। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৩ আগস্ট কিয়েভে গিয়েছেন। মোদি-জেলেনস্কি বৈঠক একটি ভারসাম্যমূলক হিসেবে কাজ হবে। যা রাশিয়া এবং ইউক্রেনের প্রতি ভারতের নীতির অনেক পশ্চিমা সমালোচককে চুপ করে দিতে পারে। তবে ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের গ্লোবাল সাউথ প্রোগ্রামের পরিচালক সারং শিদোর বলেছেন, “মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সত্যিকারের হুমকি সত্ত্বেও ভারত যদি এগিয়ে যায়, তবে তা ওয়াশিংটনের জন্য একটি সংকেত।”

লেখক: কথা সাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *