আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওই নেতারা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ১৫ আগস্ট দলের কার কী ভূমিকা ছিল, তা আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রজন্মের নেতাকর্মীদের জানা দরকার। এ জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের পাশাপাশি নিজ দলের যেসব নেতা সেদিন তাঁদের দায়িত্ব পালন করেননি, তাঁদের কথাও প্রচার করবে দলটি।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার এক আলোচনাসভায় দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা দলের প্রয়াত নেতা আব্দুর রাজ্জাক, বর্তমান উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময়ের সেনাপ্রধান ও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কে এম সফিউল্লাহর নাম ধরে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ প্রশ্ন দেশের নিস্তরঙ্গ রাজনীতিতে খানিকটা হলেও আলোড়ন তুলেছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এ নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওই সময় রক্ষীবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নীরবতা পালন করেছেন। অথচ তাঁদের ওপর ভরসা করে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন। তাঁদের এই নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগকে অনেক পিছিয়ে দেয়। দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ওই ব্যর্থতা ও দায় নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে তেমন কোনো আলোচনা এত দিন হয়নি। এখন এই আলোচনা প্রকাশ্যে করা হবে। জাতির সামনে বিষয়টি স্পষ্ট করা হবে। দলের বর্তমান প্রজন্মের নেতাকর্মীদেরও দলীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানা থাকা দরকার। এটি ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের পথচলার জন্য সহায়ক হবে।
জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কবিগুরু বলেছেন—সত্যরে লও সহজে। তিনি আরো বলেছেন—সত্য যে কঠিন/কঠিনেরে ভালবাসিলাম। বেশির ভাগ সময়ই সত্য তিক্ত হয়। কিন্তু এ জন্য তো আর সত্য গোপন করা যাবে না। সত্য যেটা সেটা সত্যই। এটা চাইলেও গোপন করা যায় না অথবা টেনে বড় করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁর বেদনার কথা বৃহস্পতিবারের আলোচনাসভায় তুলে ধরেছেন।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইতিহাসের সত্য ঘটনাকে মেনে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এতগুলো লোক মোশতাকের মন্ত্রিসভায় গেল! এরা ভয়ে গেছে, নাকি লোভে গেছে, সেটা জানার অধিকার জাতির আছে, আওয়ামী লীগের এই প্রজন্মের নেতাকর্মীদের আছে। আমাদের নেতাদের কার কী ভূমিকা ছিল, তা সামনে আনা দরকার। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের হাতের রান্না যাঁরা বেশি খেয়েছেন, তাঁরাই আবার বেঈমানি করেছেন। ইতিহাসে এঁদের ভূমিকা পরিষ্কার হওয়া দরকার।’
বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমরা চাই, যে ফর্মেই হোক যাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেঈমানি করেছেন, যাঁরা সামনে এসেছেন বা আড়ালে থেকে ষড়যন্ত্র করেছেন, যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেননি, তাঁদের সবারই যেকোনো ফর্মেই হোক বিচার হওয়া দরকার। শুধু ফাঁসি বা জেল দিলেই শাস্তি হয় এমন নয়। ইতিহাসে তাঁদের ভূমিকা তুলে ধরাও একটি শাস্তি। এতে কিছুটা হলেও তাঁদের প্রায়শ্চিত্ত হয়।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগের তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ভূমিকা আলোচিত হলে তা দলটির বতর্মান নেতৃত্বের জন্য বিব্রতকর হবে কি না জানতে চাইলে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি, জামায়াত, সিভিল প্রশাসনসহ অনেকের ভূমিকাই সামনে আসবে। আওয়ামী লীগের জন্য ভয়ের কিছু নেই। জনগণের দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ঐতিহাসিক সত্য সামনে আনতে হবে।’
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে যে ভোরে হত্যা করা হলো, সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ছিল। ছাত্রলীগের ব্যাপক জমায়েতের প্রস্তুতি ছিল। কোনো দায়িত্বশীল নেতা যদি সেদিন প্রতিরোধের ডাক দিতেন, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় মিছিলের ঢল নেমে যেত। এই মিছিল ৩২ নম্বরের দিকে এগোলে বিপথগামী সেনারা ভয়ে পালাত। হয়তো বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো যেত না, কিন্তু সেদিন বাংলাদেশ বেঁচে যেত।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে বিভিন্ন পর্যায় থেকে ষড়যন্ত্র হয়েছে। সে সময়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বুঝে বা না বুঝে ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে গেছেন। তাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের সহায়তা করেছেন। প্রকৃত গবেষণার মাধ্যমে ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচন করা দরকার। সত্য বেরিয়ে আসুক। প্রত্যেকের চরিত্র উন্মোচিত হোক। দু-চারজন নেতার চরিত্রের ওপর আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নির্ভর করে না। আওয়ামী লীগ এ দেশের জনগণের দল। জনগণের স্বার্থেই সত্য প্রকাশ জরুরি।’