মুশতাকের মৃত্যুর পর কিশোরের জীবন নিয়ে শঙ্কা

কার্টুন আঁকার অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ২৯৫ দিন যাবৎ কারাবন্দি। এ পর্যন্ত ছয় বার তার জামিন আবেদন আদালতে নাকচ হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যরা জানেন না, কোন কার্টুন আঁকার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কিশোর। চলাফেরা করতে বেশিরভাগ সময় অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে।

কিশোরের দ্রুত মুক্তি ও চিকিৎসা করানো দরকার বলে মনে করছেন রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম। আজ শুক্রবার তিনি বলেন, ‘কিশোরের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। একা একা হাঁটতে পারেন না। মুশতাক (লেখক মুশতাক আহমেদ) অতটা অসুস্থ ছিলেন না। যদি ধরে নেওয়া হয় মুশতাক স্ট্রোকে মারা গেছেন। এই স্ট্রোকটা কি স্বাভাবিক স্ট্রোক হিসেবে নেওয়ার কোনো জায়গা আছে? কোনো ব্যক্তিকে যদি এ রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়, তার শরীরে নাও কুলোতে পারে। এটাকে সিস্টেমেটিক হত্যাকাণ্ড বলতে হবে। কারণ একটা সিস্টেমের খুনের শিকার তিনি।’

হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘এই খুনের বিচার বাংলাদেশে পাওয়া যাবে এটা আমি মনে করি না। এটা শুধুমাত্র সিস্টেমেটিক খুন না, তার চেয়েও বেশি কিছু হতে পারে— এই আশঙ্কা যে নাগরিকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, এটা থেকে দায়মুক্তির জন্য হলেও নিরপেক্ষ তদন্ত করা দরকার। রাষ্ট্র এবং সরকার যদি মনে করে আসলে তারা তাকে (মুশতাক) খুন করেনি, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাহলে তাদের নিয়ে মানুষের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেটা থেকে মুক্তি নিতে তাদের স্বাধীন তদন্ত করানো দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিশোরকে নিয়ে আগে থেকেই আমাদের আশঙ্কা ছিল। মুশতাক অতটা অসুস্থ ছিলেন না। এই ঘটনার পরে কিশোরকে নিয়ে আমাদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কিশোরের দ্রুত রিলিজ এবং তার চিকিৎসা করানো উচিত।’

‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশে অন্যায়ভাবে মানুষগুলোকে ধরে ধরে নিয়ে খুন করা হচ্ছে। যখন অপরাধীদের বাইরে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। খুনিরা যখন রাষ্ট্রপতির আনুকূল্যে, সরকারের আনুকূল্যে ছাড়া পাচ্ছে এবং তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন শুধুমাত্র মত প্রকাশের জন্য মানুষকে মাসের পর মাস কারাগারে আটকে রেখে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এর অর্থ হলো হত্যাকারীর অবস্থান নেওয়া। হত্যাকারীর কাছে আমার বিচার চাওয়ার কিছু নেই। দেশের মানুষের কাছে বলার আছে, এভাবে একটি দেশ, একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না। এটার অবসান হওয়া দরকার। সবার এগিয়ে আসা উচিত, মানুষ মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে এ রকম রাষ্ট্র বানানোর জন্য’— বলেন হাসনাত কাইয়ুম।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, ‘মামলার পরবর্তী তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছিল। সেদিন আমি ছিলাম না। আমার জুনিয়র কলিগরা ছিল, আমার চেম্বার থেকে যারা রিপ্রেজেন্ট করছে। তারা বললো, মুশতাক ওয়াজ অ্যাপারেন্টলি ওকে। কিশোর দাঁড়াতেই পারছেন না। কোভিডের কারণে কিশোরের সঙ্গে ফ্যামিলি দেখা করতে পারেনি, আমরাও দেখা করতে পারিনি। আলোচনাও করতে পারিনি। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ফ্যামিলির সঙ্গে তার দেখা হয়। তখন কিশোর বলেছেন, তাকে টর্চার করা হয়েছে।’

‘কিশোর দুজন পুলিশ কর্মকর্তার স্কেচ এঁকেছেন এবং আমাদের কাছে হ্যান্ডওভার করেছেন। যে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে টর্চার করেছেন, তাদের ছবি আমাদের কাছে আছে। তিনি তার আইডিয়া থেকে ছবিগুলো এঁকেছেন। যেহেতু তিনি কার্টুনিস্ট, ফিগার নিয়ে কাজ করেন, তাই ভুল হওয়ার কথা না। এটা দিয়ে শনাক্ত করা সম্ভব কারা তাকে টর্চার করেছেন। আমাদের ২০১৩ সালের যে টর্চার অ্যান্ড কাস্টডিয়াল ডেথ প্রিভেনশন অ্যাক্ট আছে, সে অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই যায়। ফ্যামিলির সঙ্গে আলোচনা করছি, যদি তারা সেদিকে যেতে চান আমরা ব্যবস্থা নেবো’— বলেন ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া।

তিনি আরও বলেন, ‘কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হলো একটি অভিযোগে। গ্রেপ্তার করে যখন মারধর করা হবে, তখন তিনি ভিকটিমের স্ট্যাটাসে চলে যাচ্ছেন ওই সময়ের জন্য। আইন অনুযায়ী, তখন তিনি অ্যাকিউজড থাকছেন না। টর্চার করা হলে তিনি ভিকটিম। সেখানে অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপার আছে। একজন ফাঁসির আসামিরও যেসব সাংবিধানিক অধিকার থাকে, সেগুলো উহ্য হয়ে যায় না।’

লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনে জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, ‘মাঝখানে একটি দিন গেছে, ২৪ তারিখ। এর মধ্যে মুশতাক হার্ট অ্যাটাক করবেন, এটা হজম করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। হাইকোর্ট বিভাগে তাদের জামিন আবেদন করা হয়েছে মাসেরও অধিক সময় আগে। আশা করছি, আগামী রোববার বা সোমবার শুনানি হয়ে যাবে। শুনানির আগেই এ রকম একটা ঘটনা ঘটে গেল। বিষয়টি আমি কোর্টের নজরে আনবো। যদিও জামিন শুনানিতে অন্য কথা বলার সুযোগ নেই। তারপরও পুলিশের বাইরে জুডিশিয়ার ইনকোয়ারি চাইবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘মুশতাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, চ্যাটের মাধ্যমে তারা আলাপ করছিলেন। চ্যাটের বিষয়বস্তু কোনো মামলার বিষয়বস্তু হতে পারে না— যতক্ষণ পর্যন্ত সেটি পাবলিশ না করা হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত এটি অফেন্সের পর্যায়েও পড়ে না। ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা সংবিধানই দিচ্ছে। ধরে নেওয়া যাক, দুজন ব্যক্তি আপত্তিকর কথা আলোচনা করলেন। বা আলোচনার বিষয়বস্তু তৃতীয় ব্যক্তির কাছে আপত্তিকর হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তৃতীয় ব্যক্তির কাছে না বলা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা অফেন্স হচ্ছে না।’

ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, ‘মেসেঞ্জারে কার সঙ্গে কী কথা বলেছে সেটার জন্য ধরে নিয়ে এসে সফল একজন উদ্যোক্তা মুশতাককে আটকে রাখা হলো। মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে। কথা বলতে না দিলে পরিস্থিতি অন্য দিকে চলে যাবে। দিস ইজ কোয়ায়েট আনফরচুনেট।’

কারাবন্দি অবস্থায় সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘অ্যানুয়াল রবার্ট রাসেল কারেজ ইন কার্টুনিং অ্যাওয়ার্ড’ পান কিশোর। কিশোরকে মুক্তির দাবিতে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বিভিন্ন সংস্থা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

কিশোরের বড় ভাই লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *